আজ বিশ্বকর্মা পুজো। ক্যালেন্ডারের পাতায় উৎসব এলেও, আগের মতো তার রঙ, তার কোলাহল, তার উন্মাদনা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। একসময় এই দিনে আকাশ ভরে যেত রঙিন ঘুড়িতে, পাড়ায় পাড়ায় বাজত ঢাক-ঢোল, কারখানা-বাড়িতে জমত মহাভোজ। আজ যেন সবকিছুই নিঃশব্দে ঘটে যায় – চুপচাপ আসে, চুপচাপ চলে যায়।
মনে হয়, উৎসব বেঁচে আছে শুধু স্মৃতির পাতায়, আমাদের শৈশবের আঙিনায়।
কালের প্রভাবে, সময়ের অভাবে আর শহরের গতানুগতিক দৌড়ঝাঁপে আমাদের জীবনের অনেক আবেগ আজ যেন ম্লান হয়ে আসছে। মহালয়া, দুর্গাপুজো কিংবা অন্য কোনো ঐতিহ্যময় উৎসব এখন অনেকটা ক্যালেন্ডারের দিন, কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা। অথচ ছোটবেলায় মহালয়া মানেই ছিল এক বিশেষ ভোর, এক বিশেষ জাগরণ, এক গভীর আবেগ।
সকালে অন্ধকার ভোরে ঘুম ভেঙে যেত। কনকনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে স্নান সেরে বসে পড়া রেডিওর সামনে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী কতবার শুনেছি, তবুও প্রতিবার যেন নতুন করে রক্তে শিহরণ বইত। চারপাশে নীরবতা, তার মাঝে দেবী মহিষাসুর বধ করছেন – শোনার সময় মনে হতো, দেবী যেন সত্যিই অবতীর্ণ হচ্ছেন।
বাড়ির সামনে শিউলিগাছ, ভোরবেলায় পড়ে থাকা সাদা-কমলা ফুলের আস্তরণ, ন্যাশনাল স্কুলের মাঠ জুড়ে কুয়াশা – এসব মিলে আমাদের পাড়া সুভাষপল্লীতে এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ত। মহালয়া শুধু পূজোর আগমনীবার্তা ছিল না, সেটা ছিল আমাদের শৈশবের এক অমূল্য অধ্যায়।
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল লামডিংয়ের কালীবাড়ি। এখানেই হতো এলাকার সবচেয়ে বড় পূজা। পূজোর দিনগুলোয় আমরা বন্ধুরা মিলে ওখানেই সময় কাটাতাম। হাসি, আড্ডা, ঠাট্টা – কোনো কিছুরই শেষ থাকত না। পূজোর সময় যেন প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা হয়ে উঠত উৎসবমুখর।
দাদুর বাড়ির কথা আলাদা করে না বললেই নয়। মহালয়ার দিন দুপুরের ভোজ প্রায়শই হতো সেখানেই। মেজোমাসি – আমার মাসীমনি – ছিলেন আমার জীবনের কল্পতরু। বাবা-মা যেটা দিতে চাইতেন না, মাসি এক আবদারেই দিয়ে দিতেন। পুজোর সময় আমার কাপড়-চোপড়ের সবচেয়ে বড় অংশটা তিনি দিতেন। আজও মনে হয়, আমি কিছুই ফেরত দিতে পারিনি তাঁকে। তিনি চলে গেলেন একেবারে অসময়ে, রেখে গেলেন এক শূন্যতা, যা আজও ভরাট হয়নি।
অষ্টমীর সকালে ধুতি পরে বেরোনোর আনন্দ, বন্ধুদের সাথে শহরের গলি-গলি ঘুরে পুজো দেখা, নবমীর রাতে প্রায় পাগলামো করে বেড়ানো, দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের সময় ঢাকের তালে তালে নাচ, শান্তিজল আনার জন্য হুড়োহুড়ি, দাদুর বাড়িতে ভাই-বোনদের সাথে হইহুল্লোড় – এসব মনে পড়লেই বুকের ভেতর একটা দীর্ঘশ্বাস জমে যায়। আর সেই শেষ দিনের বিদায় “আসছে বছর আবার হবে” শুধু একটি স্লোগান ছিল না, ছিল চোখের জলে ভিজে যাওয়া প্রতিশ্রুতি।
আজ সকালে বিএসএস-এর (Bengaluru Sreehatta Sammelani) হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ দেখে মনে হচ্ছিল, হয়তো সব হারিয়ে যায়নি। হয়তো এখনো অনেক কিছু বেঁচে আছে – বন্ধুত্ব, স্মৃতি আর সেই অদ্ভুত উন্মাদনা। জীবন বদলেছে, আমরা বদলেছি, কিন্তু পুজো এলে সেই পুরনো স্মৃতিরা আবার জেগে ওঠে।
বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো শুধু অঞ্জলি দেওয়া বা মন্ত্রপাঠ নয়। পুজো মানে একসাথে থাকা, হইচই করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, মাছ-মাংস-বিরিয়ানি খাওয়া, আর কোথাও বেড়াতে যাওয়ার অজুহাত। পাহাড়, সমুদ্র, কিংবা কোনো অজানা শহর – সবকিছুই যেন পুজোর আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়।
হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি। কিন্তু একটা জায়গায় আমরা এখনো ভাগ্যবান – বন্ধুত্বের বন্ধন, পরিবারের টান, আর পুজোর আবেগ এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি।
আজও যখন ভোরে শিউলির গন্ধ পাই, ঢাকের আওয়াজ শুনি বা বীরেন্দ্রকৃষ্ণর কণ্ঠ ভেসে আসে, তখন মনে হয়, শৈশবের সেই দিনগুলো আসলে কোথাও হারায়নি। তারা আমাদের ভেতরেই আছে – স্মৃতির পাতায়, হৃদয়ের কোণে, ঠিক আগের মতো।