ফাইনালি ভাবলাম মাতৃভাষায় লিখি জীবনের কিছু মুহুর্ত যা অন্য ভাষায় বোঝানোর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।

জীবন বড়ই সহজ । কিন্তু আমরাই জীবনটাকে কঠিন জালে এমনভাবে আবদ্ধ করে দেই যে বেরোনোর পথ খুঁজে পেতে নিজেদেরই বড় কষ্ট হয়। আকাশের নীলিমায়, সবুজের তাণ্ডবে বা সবুজহীন রুক্ষতায় যে এক অপার্থিব সৌন্দয্য লুকিয়ে আছে তা যতক্ষণ না কেউ নিজের চোখে দেখছে বা বুঝছে , তাঁকে তা বোঝানো বড়ই কষ্টকর।

পাঁচ ঘণ্টা ট্রেক করে ৫৫০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছনোর পর শ্বাস নেব না ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে দৌড়ব সেটা বিবেচনা করার পরিস্থিতি আমাদের কারুর ই ছিল না। এক কথায় শ্বাস নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু সেই যে বললাম, আমরা তো আর শহরের সাধারণ মানুষ নই যে চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে শ্বাস নিয়ে খুশি থাকতে পারে। তাইই যদি হতো তাহলে কেন এত কষ্ট করে টাকা খরচ করে মালদ্বীপ বা সিঙ্গাপুর বা শ্রীলঙ্কা বেড়াতে না গিয়ে এই পাহাড় পর্বতে বিনা স্নানে আধ পেটে তাঁবুতে থেকে পাথরের পেছনে প্রাতকৃত্য সারতে আসি? আমাদেরই এক দাদা বলেছিল আমরা সেই খ্যাপার দল যারা পরশ পাথরের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই আর ফিরে আসি খালি হাতে ; কিন্তু নিয়ে আসি কিছু কথা কিছু গল্প, কিছু অজানা মানুষের জীবন কাহিনী যা এই খ্যাপার দলকে উত্তেজিত করে আবার সব বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে আরও এক অজানার সন্ধানে।

নদী আমার বড়ই প্রিয়। ছোটবেলায় লামডিং এর ঝুলন পুল আর তার নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নাম না জানা নদী অনেকবার পার হয়েছি। কখনও বুঝতে পারিনি যে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী পার হতে এতটা কষ্ট হবে। আমাদের গাইড জিমি না থাকলে সেদিন কেলেঙ্কারি হতো। অন্তত দশ বার একই নদী পেরিয়েছিলাম আমরা আর প্রতি বার নদীর রূপ ছিলো ভিন্ন, স্রোতের প্রভাব ছিলো অন্যরকম আর জলের নীচের সূক্ষ পাথরগুলো যেন এক প্রতিবাদের স্বরে আমাদের অগ্রগতির পথ অবরোধ করছিল ।

পথে অনেক অজানা অচেনা লোকের সাথে দেখা হয়, কথা হয়, হয় কিছু গভীর আলোচনা। সব আলোচনারবিষয়বস্তু পাহাড় নিয়ে, পাহাড় ঘিরে – আকাশের অবস্থা, ওপরে কী বরফ জমেছে, গ্লেসিয়ার টা কী খুব বিপজ্জনক, দড়ি গেইটার চাই কী, ক্রেম্পন চাই কী, কত সময় লাগল তাদের সামিট করতে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর কথা বলতে বলতে কয়েক মিনিটের মাঝেই সেই অজানা অচেনা লোকগুলোর সাথে এক নিবিড় আত্মীয়তাবোধ গড়ে ওঠে। মনে হয় কত বছর ধরে তাদেরকে চিনি, জানি আর নিঃসংকোচে তাদের সাথে মনের ভাব, ভয় প্রকাশ করে নিজেকে ইকটু হালকা বোধ করি। পাহাড় যেন এক বিশাল শক্তি দিয়ে আমাদের মনের বাঁধগুলো ভেঙে মনে করিয়ে দে যে তার কাছে লুকোবার মতো কিছুই নেই, তার কাছে শহরের মেকি মনোভাবগুলো এতই নগণ্য যে যত তাড়াতাড়ি আমরা সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসবো, তত তাড়াতাড়ি আমরা তার আশীর্বাদের যোগ্য হয়ে উঠব। সত্যিই কি মায়া এই পাহাড়ের।

১৫ই আগস্ট এ ৫৫০০ মিটার উঁচু চাক পাস পেরিয়ে নেমে আসলাম ৫২০০ মিটার উচ্চতায়। এটাই আমাদের বেস ক্যাম্প পরবর্তী তিন দিনের জন্য। পাশেই নদী, কোনো এক হিমবাহ থেকে বেরিয়ে আসা বরফগলা জল নদীর জল কে যেন আরও ঠান্ডা করে আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে। গতবার অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকে প্রচণ্ড শীতে কাহিল হয়েছিলাম। কিন্তু এবার সাব জিরো না হওয়া সত্ত্বেও ঠান্ডাটা যেন আরও বেশি লাগছে। হয়তো লাদাখের আবহাওয়া, উচ্চতা, অক্সিজেনের মাত্রা সবকিছুর একত্রিত প্রভাব। যাই হোক, দুদিন ধরে আমরা ভাবছি কীভাবে জো জোনগো সামিট করবো, মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক উচ্ছ্বাস। ৬২৫০ মিটার উচ্চতা আর এক শৃঙ্গ জয় করার শেষ মুহূর্তে আমরা এসে পৌঁছেছি। অনেক দিনের কল্পনা, পরিকল্পনা, চেষ্টা সব কিছু ভর করছে আগামী ১৬ ঘণ্টার ওপরে। রাত ১১ টা, ঘুম ভেঙে গেলো দলনেতার ডাকে। ইটস টাইম টু গো।

দলনেতা আর ওর বোন যাবে না। বোনের AMS হয়েছে । সারাদিন বেশ অসুস্থ্য ছিল। তাই দুজন গাইড আমাদের পাঁচজন কে নিয়ে চলা শুরু করল। এখন অমাবশ্যার রাত। হেডলাইট এর আলোয় চলা বেশ কঠিন যখন ট্রেইল বলে কিছু নেই বললেই চলে। তিন চার বার নদী পেরিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম এক ৭০ ডিগ্রি উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে। এখান থেকে শুরু খাড়া চড়াই। এমন নয় যে আমরা আগে কখনো এমন চড়াই চড়ি নি। কিন্তু অ্যাস দ্য mountain প্রভার্ব গোস “your mind remembers but body forgets”… আর আমার সাথে তাইই হলো কিছুদূর ওঠার পর। মাথা ব্যথা, গা গোলানো, পেটে ক্র্যাম্প, এক দুবার শরীরের ভারসাম্যতা হারিয়ে কনফিডেন্সের সমাধি হতে বেশি সময় লাগল না। বুঝলাম এগুলো AMS এর লক্ষণ। মনে মনে নিজেকে বললাম, অনেক হয়েছে বাপু – এবার নীচে নামো। প্রাণ থাকলে আগামী বার ৬২৫০ মিটার আবার হবে। মুশকিল হলো আমি যদি একা নেমে যাই একজন গাইড কে নিয়ে, পরে যদি আরও একজনকে নেমে আসতে হয়, পুরো দলকেই নামতে হবে। এটা একটা বড় রিস্ক আর দলের সাফল্য ব্যাক্তিগত সাফল্য থেকে অনেক বড়। আর তাইই প্রমাণ করল আমাদের অর্পণদা। যদিও সেই সময় পর্যন্ত অর্পণদা শারীরিক দিক থেকে অনেকটাই ভালো ছিল, নেক্সট ১২ ঘণ্টা ট্রেক করার কথা ভেবে ঠিক ডিসিশন নেওয়া একান্ত জরুরি। আর শেষ পর্যন্ত আমি আর অর্পণদা ক্যাম্পের দিকে নামা শুরু করলাম আর অনির্বাণ শুভায়ু আর রজত দা চললো জো জঙ্গ শৃঙ্গ জয়ের উদ্দেশে।

বাবা প্রায়ই বলেন, পাহাড় ঔধ্বত্যকে ক্ষমা করে না। মনের কোথাও হয়তো সেই কথাটা এমনভাবে বসে গেছিল যে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও আমি কোনো আক্ষেপবোধ করছিলাম না। যাকে ভালবাসি তাঁর কাছে হার মানাটাও যে বড়ই মনোরম বা মধুর হতে পারে, তা প্রথমবার বুঝতে পারলাম। তাও কিছুটা দুঃখ থেকে যায়। তাই মনের সেই আক্ষেপটাকে দূর করতে আমারই পুরনো বস Ratul Mazumder কে লিখলাম । আর উনার উত্তর পড়ে আমার মনের সব দুঃখ নিমেষে উধাও হয়ে গেলো। উনি লিখেছিলেন “First of all, kudos for attempting. Secondly, collaborating in extreme circumstances and sacrificing for others will give you higher sense of achievement in the long run. Thirdly, your respect for nature as one who doesn’t yield easily goes up. Many of our adventures are ego driven. That’s why we ‘conquer’ peaks, launch a final ‘assault’ to the summit. These are words used in warfare. When we use them wrt nature it exposes our combative attitude towards her. These days I attempt only those adventures that help me savour nature’s company. I don’t exceed myself because in that, ‘I’ becomes bigger than her(nature)”

তার পরের কয়েকঘণ্টা আমি আর অর্পণদা প্রচণ্ড দুশ্চিনতায় কাটালাম। বেলা একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে তিনটে, তিনটে থেকে চারটা বেজে গেলো কিন্তু কারুর দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত Wakeel কে পাঠালাম দেখে আসতে। সাড়ে চারটায় হটাৎ দূর ঢেকে লাল রঙের জ্যাকেট দেখে জড়িয়ে ধরলাম আমি আর অর্পণ দা একে অপরকে। পেরেছে, আমাদের তিন সাথী পেরেছে জো জঙ্গোর ওপর আমাদের আশার প্রদীপ জ্বালাতে, তিরঙ্গা ওড়াতে আর সবথেকে বড় কথা, ফিরে এসেছে (অ)সুস্থ্য দেহে। যদিও সেই রাত আর পরের দিন বেশ কষ্ট হয়েছিল তাদের, ৬২৫০ মিটারের জয়ের নেশা সেই সময় অনেক অসুস্থতাকেই সুস্থ করার ক্ষমতা রাখে।

তারপর আর কী। এখনতো বাড়ি ফেরার পালা। ১৮ই আগস্ট সকাল ৮ টায় শুরু হলো চাকদো গ্রামের পথে হাঁটা। প্রথমে উঠলাম ৫৫৭৫ মিটুর উঁচু কং মারুলা পাসে । তারপর শুরু হলো সেই অন্তহীন নামা অপূর্ব এক ভ্যালির মাঝ দিয়ে। নদী পেরোনো টা বেশ ভালোই রপ্ত করে নিয়েছি আমরা এই কয়েকদিন এ। তাই জুতো না খুলে পাথর থেকে পাথরে লাফ দিয়ে প্রায় ১০-১২ বার নদী পেরিয়ে অবশেষে বিকেল ৫টায় দেখতে পেলাম আমাদের জন্য অপেক্ষারত টেম্পো ট্র্যাভেলর- যান্ত্রিক সভ্যতার সাথে আমাদের নতুন করে পরিচয় আরো একবার ।।

Hope You Liked The Post ?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.2 / 5. Vote count: 89

No votes so far! Be the first to rate this post.

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Tell us how we can improve this post?

By tripotomaniac

Born at Lumding, a town in Assam, Anirban spent his childhood enjoying the whispering sounds of the woods and trees, cherishing the flora and fauna in places like Dwarband, Masimpur, Burlongfur, Mandardisa. Anirban’s writings reflect his deep love towards nature, people and a culture that we can follow to live by. In Anirban’s words, the golden sunrise, the meadows, the snow-clad tall mountains, the never ending seas, the horizon, the smell of sand and soil, large monuments, the history, the people fascinate him and take him to a different world. And he gives his father all the credit who made him feel, cherish and experience these wonders of Mother Earth. His contributions to travel sites like Tripadvisor has a reader base of over forty thousand as well as in websites like Tripoto, He is an author for Happytrips.com, a Times Travel Magazine. His first poetry collection “Osheemer Daak” – Call of the endless is recently published and available in Amazon, Flipkart. One can follow him at www.facebook.com/anirbandeb or his website https://www.endlessvista.com. His email id is tripotomaniac@gmail.com