অনেকক্ষন ধরে তাকিয়ে আছি দেয়ালের দিকে। টিকটিকিটা ঘাপটি মেরে বসে আছে এক কোনে আর অপেক্ষা করছে কখন পোকাটা কাছে আসবে আর সে আক্রমণ করবে। “বাবু, পড়ছো ?” – বাবার ডাকে থতমত খেয়ে আবার পড়া শুরু করলাম। এখন শীতের সময়। বিকেলে খেলার পর হাত মুখ ধুয়ে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছিলাম কিন্তু মনোযোগ ছিল টিকটিকির শিকার করার দিকে। বাবার ডাকে আবার মন বসানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু হয়ে উঠছিল না। এখন পোকাটা ধীরে ধীরে কাছে আসছিল আর হটাৎ টিকটিকিটা ঝাঁপিয়ে পড়লো। নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠলাম আর তার সাথে মাথায় পরলো একটা চড়। কখন যে বাবা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করি নি। এক চড়ে টিকটিকির শিকার করা দেখা মাথায় উঠলো। তাড়াতাড়ি আবার মাথা গুঁজলাম বই এর ভেতর।

আসামের এক ছোট্ট শহর আমার লামডিং। লামডিং নামটার উৎপত্তি দুটো মিকির শব্দ থেকে – লুম মানে জল আর ডিং মানে নেই। একসময় বলে জলের খুব অভাব ছিল এখানে। এখনো আছে কিন্তু ততটা নয়। সেই শহরেই আমার জন্ম, পড়াশোনা এবং শৈশব থেকে কিশোর হওয়ার অনুভূতি। শহরের একদিকে ছোট্ট একটা পাহাড়ী নদী যেটা বর্ষার সময় খরস্রোতা রূপ ধারণ করে। সেই নদীর পাশে বছরে একবার খুব বড় করে পুজো হত। বাবার NCC তে থাকার দরুন বেশ একটা বড় দল নিয়ে শীতের সময় বনভোজনের জন্য খুব যেতাম আমরা এই নদীর ধাঁরের জঙ্গলে। অনেকবার বন্দুক নিয়ে শিকারে গেছি আসেপাশের গ্রাম গুলোতে। সেই মান্দারদীসা, বারলংফারের ছেড়ে আসা সময়গুলো খুব মনে পরে।

আমাদের বাড়ি সুভাষপল্লীতে যেখানে ইলেক্ট্রিসিটি আসতে অনেক দেরী হয়েছিল। তাই হারিকেন, টেবিল লাইট দিয়েই পড়াশোনা হয়েছে ছোটবেলায়। প্রতিদিন বাবার কাজ ছিলো শলতে গুলো ভালো করে কেটে সমান করা যাতে আলোর শিখায় চিমনি কালো না হয়ে যায়। অনেক পরে কালীবাড়ির পাশে এক দোকান থেকে জেনারেটর থেকে কারেন্ট দেওয়া হয়। দাম হলো দিনে দুটাকা । যেহেতু আমি আর বোন দুজনেরই আলোর প্রয়োজন, বাবা দেয়ালে ছিদ্র করে একটা টিউব লাইটকে দুদিকে করে দিয়েছিল। আজ এত প্রাচুর্য্যতার সময় এই কথাগুলো যদিও হাস্যকর, তখন এটাই ছিল বিশাল ব্যাপার। মার কাছে আমার আবৃত্তি করার হাতেখড়ি। কবিগুরুর “প্রশ্ন” ছিল আমার প্রথম মঞ্চে আবৃত্তি করার অভিজ্ঞতা। লামডিং এ সাংস্কৃতিক পরিবেশটা ছিল অসাধারণ। স্কুল কলেজ অথবা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থার সৌজন্যে অনেক অনুষ্ঠান হতো । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকবার মঞ্চে আবৃত্তি করেছি। অনেকবার পুরস্কার ও পেয়েছি। একবার কবি সুকান্তের “হদিশ” আবৃত্তি শেখার জন্য মন্দিরা ম্যাডাম এর কাছে গেছিলাম। আর অবাক হয়ে হয়েছিলাম ওনার সাহিত্যের গভীরতা দেখে। স্কুলের কথা মনে পড়লেই মনে পরে কিছু শিক্ষক শিক্ষিকার কথা যাঁরা আমাদের সবার জীবনে একটা গভীর দাগ কেটেছেন । মনে পরে মাধব স্যারের কথা, শ্যামা স্যারের কথা, বরদিদিমিনির কথা, করুনা স্যার, মলয় স্যার এবং আরো অনেকের কথা যাঁরা অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফোটায় ।

জীবনের সেই ফেলে আসা দিনগুলো যেন অজান্তেই টানে সবাইকে আরেকবার ফিরে যেতে। হয়তো অনেক কিছু যেটা করা সম্ভব হয় নি, সেটা নতুন করে করার একটা প্রবল ইচ্ছে এখনো মনকে অশান্ত করে।  কিছুদিন পর দুর্গা পুজো । অনেক জায়গায় পূজো দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু লামডিং এর পুজো শুধু পুজো নয়, সেটা ছিল এক অবর্ণনীয় অধ্যায় যে পাতায় ফিরে যাওয়াটা আর সম্ভব নয়। মহালয়ার সকাল আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণের মাহিষাশুরমর্দিনী, অষ্টমীতে ধুতি পরার হুজুগ, বন্ধুদের সাথে পাগলের মতো শহরের আনাচে কানাচে  পূজো দেখা, দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের নাচ, শান্তিজল নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি, দাদুর বাড়িতে ভাই বোনদের সাথে হইহুল্লোড় আর আসছে বছর আবার হবে বলে কান্না, সেই দিনগুলো যেন খুবই নীরবে জীবনের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে কিছু লোক যাঁদের কথা এখনো মনকে প্রভাবিত করে, হারিয়ে গেছে কিছু স্মৃতি যেটা কখনো হটাৎ মনে করায় নিজেকে নিজের শেকড়ের কথা, হারিয়ে গেছে কিছু বন্ধু যাদের কথা ভেবে এখনো হাঁসি থামে না, হারিয়ে গেছে কিছু ঘটনা যা আর একবার ফিরে পাওয়ার জন্য মন বড়ই ব্যাকুল হয়। কিন্তু কিছু তো করার নেই; জীবনের গতিরথের লাগাম আমাদের বশীভূত নয়, কোন পথে যে কে যাবে সেটা সম্পূর্ণ আমাদের আওতার বাইরে। কিন্তু তাও একটা সময় আসে যখন সেই গতিরথের সারথী কিছু সময়ের জন্য সেই লাগামের দায়িত্ব আমাদের দেয়। প্রশ্ন হলো, তখন কি আমরা লাগামের ভার হাতে নেবো না ভারসাম্মতা হারানোর ভয়ে আবার সেই লাগামের ভার সেই অজানা অচেনা সারথীর হাতে তুলে দেবো ?

********************************************************

Hope You Liked The Post ?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 27

No votes so far! Be the first to rate this post.

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Tell us how we can improve this post?

By tripotomaniac

Born at Lumding, a town in Assam, Anirban spent his childhood enjoying the whispering sounds of the woods and trees, cherishing the flora and fauna in places like Dwarband, Masimpur, Burlongfur, Mandardisa. Anirban’s writings reflect his deep love towards nature, people and a culture that we can follow to live by. In Anirban’s words, the golden sunrise, the meadows, the snow-clad tall mountains, the never ending seas, the horizon, the smell of sand and soil, large monuments, the history, the people fascinate him and take him to a different world. And he gives his father all the credit who made him feel, cherish and experience these wonders of Mother Earth. His contributions to travel sites like Tripadvisor has a reader base of over forty thousand as well as in websites like Tripoto, He is an author for Happytrips.com, a Times Travel Magazine. His first poetry collection “Osheemer Daak” – Call of the endless is recently published and available in Amazon, Flipkart. One can follow him at www.facebook.com/anirbandeb or his website https://www.endlessvista.com. His email id is tripotomaniac@gmail.com