সেই সন্ধ্যে জুড়ে চলছে শব্দটা হোমস্টের একধাঁরে। সূর্যাস্ত হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে কিন্তু এখনো অন্ধকার নামেনি। সূর্য্যের শেষ কিছু আভা এখনো লুকোচুরি খেলছে পাহাড়চূড়ায় জমে থাকা বরফের সাথে। হোমস্টের ডে স্টাফেরা ডিউটি সেরে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। ঠিক তখনই শুরু হলো এই একঘেয়ে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। তারা যেন তীব্রস্বরে আর তারস্বরে চিৎকার করে নিজেদের উপস্থিতি জানানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য হাপ নিচ্ছে আর তখন বেঙের ডাক কানে আসছে।

হোমস্টেটা বেশ ছিমছাম। লোহিত (ব্রহ্মপুত্রের আরেক নাম) নদীর ধারে নতুন করে বানানো হয়েছে। মালিক থাকে কোনো এক শহরে যার নাম বলতে গিয়ে চোখজোড়া একেবারে বেরিয়ে এসেছিল কেয়ারটেকারের। থাক বাবা, বলতে হবে না বলে আশ্বাস দিয়ে কোনোমতে রাজি করালাম একদিন আমাদের থাকতে দিতে। এবার কেন জানি খুব ভীড় এই পাহাড়তলার ছোট্ট গ্রামটাতে। আসার সময় কে যেন বলছিল ইয়েতি দেখা গেছে গত বছর, তাই ট্যুরিস্ট এর বড্ড ভিড়। ধুর, ইয়েতি বলে কিস্সু নেই, যত্তসব গুজব ছড়ানো আর ট্যুরিস্ট দের প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবসা বাড়ানো। যাইহোক, আমরা তিনটে কামরা পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

এখনো ঝিঁঝিঁপোকা ডেকে চলেছে। অন্ধকার নেমেছে আর তার সাথে আরেকজন গলা মিলিয়ে হুক্কাহুয়া শুরু করেছে নদীর ওপারের জঙ্গল থেকে। বেশ একটা গা ছমছম করা পরিবেশ তৈরী হয়েছে গত দুঘন্টায়। এখন শুক্লপক্ষ চলছে তবে শেষের দিকে । চাঁদটা বাংলার পাঁচের থেকেও সরু হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিজের এটিচিউডটা বেশ ভারিক্কির সাথে বজায় রেখেছে। কাকু আর বাবা প্ল্যান করছে রাতে শিকারে যাবে। আমিও বায়না ধরলাম। অরুনাচলের এইদিকটায় কাকুর হেব্বী পাওয়ার। ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট বলে কথা। গাড়ির ওপর লাল বাতিটা জ্বালিয়ে সামনের সিটে জাঁকিয়ে বসে বেশ আরাম করেই আসলাম নামসাই থেকে এখান পর্যন্ত। যাচ্ছি আমরা পরশুরামকুন্ড। ঠিক যেখানে পরশুরামের হাত থেকে কুঠারটা খসে পড়েছিল। যাইহোক, অল্প পর আসছি সেই গল্পে। এখন কথা হলো রাতে শিকারে যাওয়া।

বাবা, আমি, কাকু, ড্রাইভার আর দুজন স্টাফ আর তিনটে বন্দুক নিয়ে সদলবলে আমরা বেরোলাম রাত আটটায়। কথা হলো এগারোটার মাঝে ফিরে আসবো আর তারপর রান্না হবে। শিকারে কিছু পেলে তা দিয়ে, আর না হলে খাসির মাংস। শিকার করা তো একটা নিমিত্তমাত্র এই রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার। কাউকে দেখে মনে হচ্ছিল না যে তারা শিকারে এসছে। আমার বয়স তখন এগারো, এডভেঞ্চারের নেশায় রক্ত উথলে পড়ছে, আশপাশে দেখে চলছি যদি কিছু দেখা যায়। যাইহোক, দুঘন্টা চলার পর একটা ছোট বিশ্রামঘর দেখতে পেলাম। অল্প জিড়িয়ে সবাই ঠিক করলো ফেরার। সত্যি বলতে পা আর কোমর দিচ্ছিল না সঙ্গ আমার। তাই এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম। দূর থেকে আলো দেখতে পেয়ে কি যে আনন্দ হলো বলে বোঝাতে পারবো না। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নদীর ধারে গিয়ে বসলাম। চাঁদের আলোটা এখন বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। চাঁদের আলো জলস্রোত যে ফেনা তৈরী করছে তার ওপর যেন এক রুপোলি মায়ার সৃস্টি করছে। বাবু, খানা তৈয়ার হ্যায় , হটাৎ একজন স্টাফের গলার স্বর শুনে পেছন ফেরলাম। বললাম আসছি।

থতমত খেয়ে গেলাম ডাইনিং হল আর আয়োজন দেখে। যে কেয়ারটেকার আমাদের প্রথমে রুম দিতে অল্প ইতস্তত করছিল, সে যখন জানতে পারলো কাকু কে, আয়োজন করতে কোন ত্রুটিই রাখেনি। খেয়ে দেয়ে আমরা বিদায় নিলাম রাতের তারাভরা আকাশ থেকে । কাল আমাদের যাত্রা শুরু হবে সকাল ছটায় । গন্তব্যস্থল সোজা পরশুরামকুন্ড।

এখন মকর সংক্রান্তির সময়; তাই হাজার হাজার লোকের সমাগম এই কুণ্ডে। পিতা ঋষি জামদগ্নির আদেশে যখন পরশুরাম মাতা রেণুকার শিরচ্ছেদ করেন, তখন সেই কুঠার তাঁর হাতে আটকে গেছিলো। বহু চেষ্টার পরও যখন সেই কুঠার মুক্ত করতে পারছিলেন না, তখন অনেক ঋষির উপদেশে তিনি এসেছিলেন এখানে। লোহিত নদীর পবিত্র জলে হাত দেবার সাথেই সেই কুঠার থেকে তিনি মুক্তি পান। সেই সময় থেকে এই স্থানের নাম হলো পরশুরামকুন্ড।  সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছয় হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত এই কুণ্ডের আরো অনেক গুণ। অনেকের মতে চর্মরোগের নিরাময় হয় এই জলে, আবার অনেকে মনে করে জীবনের সারা পাপ ধুয়ে যায় যদি কেউ এখানে একবার স্নান করে। যাইহোক আমাদের কারুরই এসবের ওপর খুব একটা বিশ্বাস নেই। আমরা হলাম প্রকৃতিপ্রেমী। তাই যতটা সময় সেখানে ছিলাম, প্রাণ ভরে দেখলাম প্রকৃতির অনবদ্য সৃষ্টিকে,  ভাবছিলাম কেমন করে সম্ভব সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে লোকেদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান কাল পাত্র একসাথে জুড়ে দেবার; কেমন করে সম্ভব সেই মহাভারতের যুগে ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে মনিপুর নাগাল্যান্ড ত্রিপুরা আসামের মতো দুর্গম জায়গাকে এক মহাকাব্যে ব্যক্ত করা , কেমন করে সম্ভব সেই যুগের লোকেদের এই সব জায়গায় ভ্রমণ করার, কেমন করে ? তখন মনে আসলো মা বলেছিল এবং এখনো প্রায়ই বলে, রামায়ণ মহাভারতে যাহা নাই ভূভারতে তাহা নাই। সত্যি কথাই বটে।

এখন প্রায় দুটো বাজতে চললো। তাড়াহুড়ো করে কুণ্ডে গিয়ে কয়েকফোঁটা জলের ঝাপটা মেরে ফিরে আসলাম ওপরে। মধ্যাহ্নভোজন টা বেশ ভালোই হলো। কাকু বললো তাড়াতাড়ি করে বেরোতে কারণ দেরি হলে তীর্থযাত্রীদের ভীড় হবে রাস্তায়।

বিদায় দাও হে পরশুরামকুন্ড।

Disclaimer: Journey was made in 1988. Wrote based on what I remember till date without any addition so as to keep the feel natural as far as possible.

Hope You Liked The Post ?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 21

No votes so far! Be the first to rate this post.

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Tell us how we can improve this post?

By tripotomaniac

Born at Lumding, a town in Assam, Anirban spent his childhood enjoying the whispering sounds of the woods and trees, cherishing the flora and fauna in places like Dwarband, Masimpur, Burlongfur, Mandardisa. Anirban’s writings reflect his deep love towards nature, people and a culture that we can follow to live by. In Anirban’s words, the golden sunrise, the meadows, the snow-clad tall mountains, the never ending seas, the horizon, the smell of sand and soil, large monuments, the history, the people fascinate him and take him to a different world. And he gives his father all the credit who made him feel, cherish and experience these wonders of Mother Earth. His contributions to travel sites like Tripadvisor has a reader base of over forty thousand as well as in websites like Tripoto, He is an author for Happytrips.com, a Times Travel Magazine. His first poetry collection “Osheemer Daak” – Call of the endless is recently published and available in Amazon, Flipkart. One can follow him at www.facebook.com/anirbandeb or his website https://www.endlessvista.com. His email id is tripotomaniac@gmail.com